কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ আজ লোকসভায় ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন। তৃতীয় মোদী সরকারের এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এই নিয়ে টানা আটবার বাজেট পেশ করে শ্রীমতি সীতারামন রেকর্ড গড়েছেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দ্রুত গতির অর্থনীতি হিসাবে উঠে এসেছে। এই ধারা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে কেন্দ্র। সামজের সর্বস্তরে ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ সুনিশ্চিত করাই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।
এবারের বাজেটে ১০ টি মূল ক্ষেত্রের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আত্মনির্ভরতা বাড়িয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এই বাজেট বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
বিকাশের ক্ষেত্রে কৃষিকে বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হিসাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের ব্যয় নির্বাহের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী মন্দা বাজারে ভারত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর জন্য ফসল বৈচিত্র্যে বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী ৫ বছর স্থিতিশীল বিকাশ ধরে রাখাই অন্যতম লক্ষ্য।
গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশে মহিলা, দরিদ্র এবং প্রান্তিকতম কৃষকদের ভূমিকাকে উল্লেখ করে শ্রীমতি সীতারামন বলেন, শাকসব্জী এবং ফসলের উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য অন্তর্ভুক্তি মূলক প্রকল্পের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী ধনধান্য কৃষি যোজনার সূচনা হচ্ছে। ১০০ টি কম উন্নয়নশীল কৃষি জেলাকে এর অন্তর্ভুক্ত করার ফলে লাভবান হবেন এক কোটি ৭ লক্ষ কৃষক। মাসকলাই, অড়হড় এবং মসুর ডাল চাষে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় উচ্চ উত্পাদনশীল বীজ যোজনা এবং বিহারে মাখানা বোর্ডে গঠন করে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কাপাস তুলো উত্পাদনের উন্নয়নে চালু হচ্ছে বিশেষ মিশন। আগামী ৫ বছরে দীর্ঘ তন্তু কাপাস চাষে প্রভূত উন্নতি হবে।
কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ফাইফ এফ ভিশনকে উত্সাহিত করা হচ্ছে। এখন থেকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মিলবে ঋণ ।
অসমের নামরূপে খোলা হবে ইউরিয়া কারখানা। ভারতীয় ডাক বিভাগকে সবচেয়ে বড় লজিস্টিক বা পরিবহন ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সমবায় ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের জন্য এনসিডিসিকে কাজে লাগানো হবে। বিনিয়োগ এবং ব্যবসার সীমা বাড়ানো হবে আড়াই গুণ পর্যন্ত ।
এমএসএমই-র ক্ষেত্রে ঋণ গ্যারান্টির পরিমাণ ৫ কোটি থেকে বেড়ে ১০ কোটি করা হচ্ছে। স্টার্ট আপের ক্ষেত্রে এই হার ১০ কোটি থেকে বেড়ে হচ্ছে ২০ কোটি। সঠিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ে ঋণের অর্থ মেটালে এমএসএমই গুলিকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে। এমএসএমই-তে স্থাপন করা হবে জাতীয় উত্পাদন মিশন ।
৫ লক্ষ মহিলা, তপশিলি জাতি, উপজাতির শিল্পোদ্যোগীদের জন্য নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন শিল্পোদ্যোগীদের জন্য ৫ বছরে ২ কোটি টাকার টার্ম লোন দেবে সরকার।
জুতো এবং চর্ম শিল্পের ওপর বিশেষ নজর দিয়ে ফোকাস প্রডাক্ট স্কিমের সূচনা হচ্ছে। চর্ম শিল্পে ২২ লক্ষ কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। খেলনা উত্পাদনে ভারতকে বিশ্বমানের করে তুলতে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে প্রসূতী মা এএবং শিশুর যত্নে বিশেষ নজর দিতে পোষণ টু পয়েন্ট জিরোর সূচনা করছে সরকার। আগামী ৫ বছরে সরকারি স্কুলে ৫০ হাজার অটল টিঙ্কারিং ল্যাব খোলা হবে। গ্রামীণ সরকারি ও মাধ্যমিক স্কুল এবং
প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ব্রডব্যান্ড পরিষেবা দেবে সরকার। দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিতে ৫ টি জাতীয় উত্কর্ষ কেন্দ্র খোলা হবে।
ভারতীয় ভাষা পুস্তক প্রকল্পের অধীনে পাঠ্য বইগুলি ডিজিটাল ফরম্যাটে পাওয়া যাবে। বাড়ানো হবে আইআইটিগুলির ক্ষমতা। আইআইটি পাটনায় নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণ এবং পরিকাঠামগত বিকাশের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তিনটি এআই উত্কর্ষ কেন্দ্র চালু করবে সরকার। এজন্য ৫০০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশের প্রতিটি জেলা সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার সেন্টার খোলা হবে। আগামী তিন বছরে তৈরি করা হবে ২০০ টি ডে কেয়ার ক্যান্সার সেন্টার। ৩৬ টি জীবনদায়ী ক্যান্সার ও দুরারোগ্য অসুখের ওষুধকে পুরোপুরি সীমা শুল্ক মুক্ত করা হল। এখন থেকে রোগীরা আরও ৩৭ টি ওষুধ বিনামূল্যে সরকারি কেন্দ্র থেকে পাবে।
দেশের মেডিকেল কলেজ গুলিকে আগামী বছর আরও ১০ হাজার আসন বাড়ানো হবে। ৫ বছরে এই সংখ্যা বাড়বে ৭৫ হাজার।
এক কোটি গিগওয়ার্কারদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের আইডেন্টিটি কার্ড দেওয়া হবে। পিএম জন আরোগ্য যোজনার সুবিধা পাবেন তারা। নাম নথিভুক্ত করা হবে ই শ্রম পোর্টালে।
২০২৫ থেকে ৩০ সাল পর্যন্ত সম্পত্তির বিলগ্নিকারী প্রকল্পের সূচনা করা হচ্ছে। বিদ্যুত বন্টনের উন্নতির স্বার্থে রাজ্যগুলিকে বিশেষ উত্সাহ দেওয়া হবে। রাজ্যের জন্য জিএসডিপি-তে অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির অনুমতি করা হয়েছে। ২০ হাজার কোটি টাকার পরমাণু শক্তি মিশন চালু করা হবে।
নতুন পরিকল্পনায় ১০ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ করবে সরকার। রাজ্যগুলিকে দেড় লক্ষ কোটি টাকা সুদ মুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। পরমানু শক্তি এবং এ সংক্রান্ত আইনে সংশোধন আনবে সরকার।
২৬৫ হাজার কোটি টাকার সামুদ্রিক বিকাশ তহবিল গঠন করা হবে। এতে কেন্দ্রীয় সরকার ৪৯ শতাংশ অংশীদারিত্ব রাখবে।
১শো শতাংশ লক্ষ্য পূরণের জন্য জল জীবন মিশনের সময়সীমা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
শহরের বিকাশে এক লক্ষ কোটি টাকার আরবান চ্যালেঞ্জ ফান্ড খোলা হবে।
পরিমার্জিত উড়ান প্রকল্পের অধীনে দেশের ১২০ টি নতুন গন্তব্যকে সংযুক্ত করা হবে। ১০ বছরে সারা দেশে চালু করা হবে ১২০ টি নতুন বিমান বন্দর।
বিহারে গড়ে তোলা হবে গ্রীন ফিল্ড এয়ারপোর্ট।
মিথিলাঞ্চলে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা কৃষকদের সুবিধার্থে পশ্চিমী কোশী নদী যোজনায় দেওয়া হবে অর্থ সহায়তা।
স্বামী ফান্ড টু প্রকল্পের আওতায় এক লক্ষ আবাস তৈরি করা হবে। স্থাপন করা হবে রাজ্য খনন সূচকাঙ্ক। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সংক্রান্ত নীতি প্রস্তাব করা হবে।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় ৫০ টি পর্যটন কেন্দ্রে বিকাশের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে জড়িত পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে সংস্কারের লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। চিকিত্সা পর্যটনে আরও উত্সাহ দেবে সরকার। এজন্য ভিসার নিয়ম নীতি আরও সরল করা হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের জন্য ডিপ টেক ফান্ড তৈরির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য পি এম রিসার্চ ফেলোশিপের অধীনে ১০ হাজার ফেলোশিপ দেওয়া হবে। ১০ লক্ষ জার্ম প্লাজমার জন্য খোলা হবে দ্বিতীয় জিন ব্যাঙ্ক। চালু করা হবে জাতীয় ভূস্থানিক মিশন।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। জ্ঞান ভারত মিশনের আওতায় এক কোটি পান্ডুলিপিকে সংরক্ষণ করা হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধার জন্য ভারত ট্রেডনেট নামের ডিপিআই শুরু করছে কেন্দ্রীয় সরকার। শুরু হচ্ছে এক্সপোর্ট প্রমোশন মিশন।
আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করতে রাষ্ট্রীয় ফ্রেমওয়ার্কের সূচনা।
আগামী সপ্তাহে নতুন আয়কর বিল প্রস্তুতের প্রস্তাব করা হবে। একশোটিরও বেশি আইনকে অপরাধের আওতা থেকে বের করে আনতে দ্বিতীয় পর্বে জন বিশ্বাস বিল নিয়ে আসা হবে। বীমার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ৭৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হবে। ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে বিনিয়োগ বান্ধব সূচক চালু করা হচ্ছে।
সরকারি ব্যাঙ্কগুলির জন্য তৈরি হবে বিশেষ ক্রেডিট সোর্স নিরূপন ব্যবস্থা। কেওআইসি প্রক্রিয়াকে সরল করতে বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এজন্য ২০২৫ কেন্দ্রীয় কেওয়াইসি রেজিস্ট্রি সংশোধন করা হবে। ভারতে ব্যবসা সরল করতে তারা দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ বলেও সরকার জানায়।
উত্পাদন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সংস্কার সাধনে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি তৈরি করা হবে। রাজ্যগুলি কতটা বাণিজ্য বান্ধব তা স্থির করতে বিশেষ স্টোরিং ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।
সরকারের মোট ব্যয় ৫০ দশমিক ৬/৫ লক্ষ কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মোট কর সংগ্রহ ২৮ দশমিক ৩/৭ লক্ষ কোটি টাকা থাকবে বলে সরকারের অনুমান। বাজারে সরকারের ঋণের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮/২ লক্ষ কোটি টাকা।
৬ টি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি সহ বেশ কয়েকটি সামগ্রীর ওপর কর ছাড় দেওয়া হবে। এর ফলে দাম কমবে মোবাইলের ব্যাটারির। এলসিডি, এলইডি, টিভি তৈরিতে উত্সাহ দিতে ছাড়ের ঘোষণা সরকারের।
জাহাজ নির্মাণে কাঁচা মালের ওপর ছাড়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। হস্তশিল্পের রপ্তানিতে উত্সাহ দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ ব্যবস্থা রাখছে।
৯ টি পণ্যকে নতুন আয়কর বিলকে আরও ন্যয়সম্পন্ন করে তোলা হবে।
মধ্যবিত্তের ক্ষমতায়ন, সরকারের বিশেষ নজরে রয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী জানান। প্রবীণ নাগরিকদের উত্স মূলে সংগৃহীত কর টিডিএস-এর আওতায় আসার জন্য লেনদেনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
নির্দিষ্ট তারিখের পর টিডিএস জমাকে অপরাধ মুক্ত বলে ঘোষণা করা হল। ব্যক্তিগত আয়কর দাতাদের আপডেটেড রিটার্ন জমা দেওয়ার মেয়াদ ২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৪ বছর করা হয়েছে।
সরকার কর মেটানোর ব্যবস্থা সরলীকরণে বিবাদ সে বিশ্বাস প্রকল্পের সূচনা করেছিল, সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে বলে অর্থমন্ত্রী জানান।
ভারতের উন্নয়নে মধ্যবিত্তের ভূমিকা অপরিসীম বলে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী জানান, তাদের করের বোঝা কমাতে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কোনো আয়কর দিতে হবে না। বেতনভুক্ত কর্মীদের স্টান্ডার্ড ডিডাকশন সহ এই অঙ্ক ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিকে করের আওতার বাইরে রাখা হচ্ছে। ৪ থেকে ৮ লক্ষ পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ৮ থেকে ১২ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, ১২ থেকে ১৬ লক্ষ পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, ১৬ থেকে ২০ লক্ষ টাকার আয়ে ২০ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ লক্ষ আয়ের ক্ষেত্রেপর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং ২৪ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে।
পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে ৭ ধরনের ট্যারিফ রেট তুলে নেওয়া হচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতির হার জিডিপির ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।